কফন (মুন্সি প্রেমচাঁদ)
-বর্ণালী জানা সেন
ঘরের দাওয়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাপ-বেটা। চুলার আগুন নিভে এসেছে। ঘরের ভেতর বেটার বউ বুধিয়া প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। প্রবল যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে এমন আর্তনাদ করে উঠছে যে বাপ বেটাকে বুকে হাত চেপে মনকে শান্ত করতে হচ্ছে। শীতের রাত। চারিদিক নিস্তব্ধ…শুনশান। পিচকালো অন্ধকারে ডুবে আছে সারা গ্রাম।
ঘিসু বলে… ‘মনে হয় ও আর বাঁচবে না। সারা দিন ধরে যন্ত্রণায় আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে। গিয়ে দেখ কী হাল ওর’।
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মাধবের। বিষণ্ণ গলায় সে বলে… ‘মরলে মরবে। আমি দেখে আর কী করব?’
‘তুই কি পাষাণ? সারা বছর ধরে ওর সঙ্গে ফূর্তি করলি আর এখন এমন বেইমানের মতো কথা বলছিস’।
‘ ওর এই যন্ত্রণা চোখে দেখতে পারছি না’।
সাধারণ চামারের বাড়ি এটা। এ বাড়ির বদনাম সারা গাঁয়ে। একদিন গতর খাটিয়ে কাজ করলে পরের তিনদিন শুয়ে বসে থাকবে ঘিসু। বেটা মাধব এক আরো এক কাঠি ওপরে। কুঁড়ের হদ্দ। এক ঘণ্টা কাজ করলে আরেক ঘণ্টা সে ছিলিম টানবে। তাই ওদের আর কেউ কাজে ডাকে না। বাড়িতে একমুঠো চাল থাকলে বাপ বেটা কেউ কাজ করবে না। তার দু এক দিন উপোস গেলে ঘিসু গাছের ডালপালা কেটে আনে। আর মাধব সেটা বাজারে বেচতে যায়। হাতে যতক্ষণ টাকা থাকবে ততদিন কোনো কাজ না করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে তারা। তারপর ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে না পারলে আবার গাছের ডালপালা কাটবে…এদিক ওদিক কাজের খোঁজ করবে। গাঁয়ে কাজের কোনো অভাব নেই। চাষাভুষো মানুষেরই বাস এই গাঁয়ে। কাজ করতে চাইলে হাজারটা কাজ পাওয়া যায়। খুব বাধ্য না হলে এই বাপ-বেটাকে কেউ কাজে ডাকে না। ডেকেই বা কী হবে! দুজনে মিলে একজনেরও কাজ করবে কিনা সন্দেহ।
তারা যদি সাধু সন্ত হত তাহলে তাদের মনের শান্তি, আর ধৈর্যের জন্য বিশেষ কিছুই করতে হত না। কারণ এটা তো তাদের স্বভাবেই রয়েছে। অদ্ভূত জীবন তাদের। দু তিনটে মাটির হাঁড়ি ছাড়া বাড়িতে আর কিচ্ছু নেই। শতচ্ছিন্ন জামাকাপড় পরে তারা লজ্জা নিবারণ করে। গলা অবধি দেনায় ডুবেও কোনো কিছুতে তাদের কোনো হেলদোল নেই। পাওনাদাররা তাদের গালাগালি করে মারধরও করে কিন্তু কিছুই তাদের গায়ে লাগে না। কোনো কিছুতেই তাদের কষ্ট হয় না। তাদের ধার দিয়ে শোধ পাওয়ার আশা করে না কেউ। তা সত্ত্বেও গাঁয়ের লোকজন এটা ওটা দিয়ে থাকে তাদের। মরশুম এলে তারা মাঠ থেকে আলু আর মটরশুঁটি তুলে এনে আগুনে পুড়িয়ে খায়। তানা হলে আখের খেত থেকে পাঁচ-দশটা আখ এনে ছিবড়ে চুষেই তারা রাত কাটিয়ে দেয়। এইভাবেই নিজের জীবনের ষাটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে ঘিসু। সুযোগ্য ছেলের মতো সবকিছুতে বাবাকেই অনুসরণ করছে মাধব। কোনো সময় বাপকেও সে ছাড়িয়ে যায়।
আগুনের ধারে বসে তারা আলু পোড়াচ্ছে। কারো একটা খেত থেকে এই আলু তারা তুলে এনেছে। ঘিসুর বউ তো কবেই মরে ফৌত। গেল বছর মাধব বিয়ে করেছে। বাড়িতে বউ আসার পর তাদের ছন্নছাড়া জীবনে একটু শ্রী এসেছে। ধান ভেনে, ঘাস কেটে সে দু এক সের আটা জোগাড় করে আনে। এইভাবে নির্লজ্জ বেসরম দুটো মানুষের মুখে খাবার জুগিয়ে যায়। ঘরে বউ আসার পর বাপ-বেটা দুজনেই আরো কুঁড়ে হয়ে গেছে। এখন আর কুটিগাছটি নাড়তেও চায় না তারা। একটু নবাবি চালও এসে গেছে তাদের মধ্যে। কেউ কোনো কাজের জন্য ডাকতে এলেও তারা নড়তে চায় না। তার ওপর দুগুন মজুরি চেয়ে বসে। এখন তারা বসে আছে বউটা মরার অপেক্ষায়। ও আবাগী মরলেই তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।
চুলা থেকে একটা আলু তুলে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ঘিসু বলে… ‘ যা বেটা, বউয়ের কী অবস্থা একটু দেখে আয়। মরলে ভূত পেত্নীর উপদ্রব সহ্য করতে হবে। এর বেশি কিছু তো আর নয়। এখানে ওঝা এলেও এক ট্যাকা চেয়ে বসবে। কোত্থেকে জোগাড় করি এই ট্যাকা!’
ঘরের ভেতরে ঢুকতেও ইচ্ছে করে না মাধবের। সে ভেতরে গেলেই যে বাপটা সব আলু খেয়ে ফেলবে। তাই সে একটা অজুহাত দিয়ে বসে… ‘আমার ভেতরে যেতে ভয় করছে’।
‘ কীসের ভয় তোর। আমি তো এখানে আছি নাকি’।
‘তাহলে তুমি গিয়ে দেখো গে যাও’।
‘আমার বউয়ের যখন মর মর অবস্থা তখন আমি তিন দিন ওর পাশে ঠায় বসে থেকেছি। এক পাও নড়িনি। এখন আমি ভেতরে গেলে তোর বউ আমাকে দেখে লজ্জা পাবে না? ঘোমটার আড়ালে আমি কোনোদিনও তার মুখ দেখিনি। আজ আমি তাকে আদুল গায়ে দেখতে পারি? তা ছাড়া আমাকে দেখলে ওর শরীরেরও কষ্ট আরো বাড়বে। ও তো তখন ভালো কোৎ দিতেও পারবে না।
‘আমি একটা কথা ভাবছি…বাচ্চাটা যদি জন্মায় তাহলে তো শুকনো আদা, মোটা চিনি, তেল লাগবে। বাড়িতে তো কিচ্ছু নেই’।
‘ সব এসে যাবে। ভগবান যদি বাচ্চাটাকে আনেন তাহলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যারা এখন আমাদের এক পয়সাও ঠেকায় না তারাই তখন ডেকে জিনিসপত্র দেবে খন। আমার নটা বাচ্চা জন্মেছে। কারো জন্মের সময়ই বাড়িতে কিছু ছিল না। কিন্তু সব ব্যবস্থা তো হয়ে গেছে’।
গ্রামের যেসব চাষি দিনরাত এক করে খাটে তাদের অবস্থাও যে এই বাপ-বেটার চেয়ে ভালো এমন নয়, তবে পরিশ্রমী চাষিদের থেকে যে সমাজে শোষণকারীদের সম্মান বেশি, সেখানে আশ্চর্যেরই বা কী আছে! কিন্তু এটা মানতেই হবে যে, ঘিসু বুদ্ধিমান। বেকার খাটাখাটনি করে না মরে সে ভাঁওতাবাজদের দলেই নাম লিখিয়েছে, যদিও ভাঁওতাবাজদের ছল চাতুরি তার বিশেষ আসে না। ফলে তার সমাজের অন্যান্যরা যদি বা কখনো সখনো গ্রামের মুখিয়া হয়ে বসে তাকে কোনো দলই বিশেষ পাত্তা দেয় না। তবে যাইহোক একটা সান্ত্বনা আছে তার মনে। যতই খারাপ অবস্থা হোক না কেন চাষিদের মতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম তাকে করতে হবে না। আর তার সারল্য আর তার অসহায়তার সুযোগও কেউ নিতে পারবে না।
চুলা থেকে গরম আলু তুলে হামলে পড়ে খেতে থাকে তারা। আলু জুড়িয়ে কখন ঠান্ডা হবে সেই তর টুকুও তাদের সয়না। আগের দিন থেকে পেটে একটা দানাও পড়েনি। গরম আলু খেতে গিয়ে দুজিনেরই জিভে ছ্যাঁকা লাগে। আলু ছাড়ানোর সময় ওপর ওপর তেমন গরম লাগেনি। কিন্তু মুখে পোরা মাত্র জিভ, গলা, টাগড়া পুড়ে যাওয়ার জোগাড়। আলুর বাইরেটা ঠান্ডা হলে কী হবে ভেতরটা তো গরমই রয়ে গেছে। এই গরম জিনিস মুখে ভরে রাখার চেয়ে জলদি পেটে চালান করে দেওয়াই ভালো। পেটে গিয়ে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে খন। তাই গপাগপ খেতে থাকে তারা। গরম আলু মুখে দিয়ে তাদের চোখে জল এসে যায়।
ঘিসুর হঠাৎ সেই বিয়েবাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। জমিদারবাড়ির বিয়ে বলে কথা। সেই কুড়ি বছর আগেকার ঘটনা কিন্তু সবকিছু তার স্পষ্ট মনে আছে। বিয়েবাড়িতে সে বরযাত্রী গিয়েছিল। সেদিন পেটভরে খেতে পেয়েছিল সে। এত খাবার দাবার সে জীবনে চোখে দেখেনি। আজও তার মনে পড়ে সে কথা। ছেলেকে সে বলে… ‘ বুঝলি বেটা। কী ভোজ ছিল সেদিন! অমন খাবার জীবনে চোখে দেখিনি। ভরপেট খাওয়া কাকে বলে সেদিনই আমি বুঝেছিলাম। মেয়ের বাড়ি থেকে সবাইকে পেট ভরে লুচি খাইয়েছিল। একেবারে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা। তারপরে ছিল চাটনি, রায়তা, তিন রকমের সবজি, কীসের যেন একটা ঝোল, দই…মিষ্টি। কী আরাম করে যে সেদিন খেয়েছিলাম! যে যত পারে খাও। কেউ না বলার নেই। সবাই তো গলা অবধি খেয়েছিল সেদিন। খেয়েদেয়ে পেটে জল খাওয়ারও জায়গা নেই। পরিবেশনকারীরা আসছে। তারপর পাতে গোল গোল মিষ্টি দিয়ে যাচ্ছে। কী মিষ্টি গন্ধ! খাব না বললেও কেউ কথা শুনছে না। তারা ট্রে নিয়ে আসছে। আর পাতে খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাত পেড়ে খেয়ে দেয়ে সবাই মুখ মোছার পরে ওরা পান দিল। অত কিছু খাওয়ার পরে আমার আর পান খাওয়ার মতো জায়গা আছে নাকি? খেয়ে দেয়ে আমি তো আর দাঁড়াতেই পারি না। কোনোরকমে টলতে টলতে কম্বলের ওপর শুয়ে পড়লাম। জমিদার মশাই বড্ড দিলদরিয়া। মনটা ছিল তার সমুদ্রের মতো বড়।
এই ভূরিভোজের কথা শুনে মাধবেরও জিভে জল এসে যায়… ‘ ইসস,এখন যদি আবার কেঊ এমন ভোজ দিত’।
‘এখন অমন পাত পেড়ে কি কেউ খাওয়াবে! সে সময়ের কথাই ছিল আলাদা। এখন সবাই টাকা বাঁচানোর কথা ভাবে… ‘ এই বিয়েবাড়িতে খরচ কোরোনা, পূজাপার্বণে খরচ কোরোনা’…এই তো সবার কথা। ওদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো গরিব মানুষের রক্ত জল করা পয়সা বাঁচিয়ে হবেটা কী? পয়সা বাঁচানোর বেলা সবাই আছে। শুধু খরচ করার বেলায় কেউ নেই’।
‘তুমি তো নিশ্চয়ই কুড়িটা লুচি খেয়েছিলে’?
‘কুড়িটার বেশিই খেয়েছিলাম’।
‘আমি হলে তো পঞ্চাশটা খেয়ে ফেলতাম’।
‘ আমিও পঞ্চাশটাই খেয়েছিলাম। এর কমে আমার হতই না। তখন অনেক সুস্থ সবল ছিলাম। আমি যা ছিলাম তুই তো তার ধারেকাছেও আসিস না’।
খাওয়া দাওয়ার পরে দুজনে জল খেল। তারপর ধুতিটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শরীরটা কুঁকড়ে গরম চুলার ধারে শুয়ে পড়ল…ওদের দেখে মনে হয় যেন বিরাট দুটো সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে’।
বুধিয়া তখনও আর্তনাদ করে যাচ্ছে।
২
সকালে উঠে মাধব কুঁড়ের ভিতর ঢুকে দেখে তার বউয়ের শরীর একদম ঠান্ডা। তার মুখের ওপর মাছি ভনভন করছে। পাথরের মতো চোখ উলটে রয়েছে। তার সারা গা ধুলোয় ভর্তি। বাচ্চাটা পেটেই মরেছে।
মাধব দৌড়ে বাপের কাছে খবর দিতে আসে। তারপর দুজনেই বুক চাপড়ে চাপড়ে বিলাপ শুরু করে। তাদের কান্না শুনে পাড়াপড়শিরা সব ছুটে আসে। এই শোকার্ত মানুষদুটোকে সবাই সান্ত্বনা দেয়। এই সময় মানুষ আর কীইবা করবে। কিন্তু এখন ওত কান্নাকাটি আর বিলাপ করলে চলবে না। মৃতদেহ দেহ ঢাকা দেওয়ার জন্য কাপড় (কফন) লাগবে…কাঠ লাগবে। তাদের তো হাঁড়ির হাল। শিকারি পাখির যেমন বাসায় মাংস সঞ্চয় করে রাখতে হয় না, তেমনই এই বাপ বেটার ঘরেও এক পয়সাও তো জমা নেই।
বাপ-বেটা কাঁদতে কাঁদতে গেল গ্রামের জমিদারের কাছে। এই দুটো মানুষের মুখদর্শন করতে চান না জমিদার। এরা চুরি করেছে…সময়মতো কাজে আসেনি। তখন তিনি এদের মারধোরও করেছেন। ঘিসুকে দেখে জমিদার জিগ্যেস করেন…’ কী ঘিসুয়া কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? এখন তোর দেখাই পাওয়া যায়না। ভাবলাম এ গাঁয়ের পাট বোধহয় উঠিয়েছিস’।
জমিদারের কথা শুনেই ঘিসু তো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কান্না আর থামে না তার… ‘ কী যে সমস্যায় পড়েছি! কাল রাতে মাধবের বউ মরেছে। সারা দিন যে যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। হুজুর মাঝরাত অবধি তার মাথার কাছে বসেছিললাম আমরা। যতখানি সম্ভব ওষুধপত্রও দিয়েছি। কিন্তু ওকে আর আটকাতে পারলাম না। এখন আমাদের কে দেখাশোনা করবে হুজুর। আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেল…আমাদের ঘরটা শ্মশান হয়ে গেল। হুজুর আমি আপনার চাকর। আপনি ছাড়া ওর শেষকৃত্যের দায়িত্ব কে নেবে? ঘরে যা পয়সা ছিল ওষুধেই সব খরচ হয়ে গেছে। এখন হুজুর যদি দয়া করেন তবেই ওর শেষ কাজটা ঠিকমতো হয় আর কি। আপনি থাকতে আমি কার কাছে আর কাছেই বা আর হাত পাতব?’
জমিদার মানুষটা এমনিতে ভালো। মনে দয়ামায়া আছে। কিন্তু ঘিসুকে দয়া দেখানো মানেই কালো চাদরকে রঙ করতে যাওয়ার সামিল। জমিদারের একটু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করে… ‘ দূর হয়ে যা এখান থেকে। ঘরেই লাশটা রেখে দে। ওখানেই ওটা পচুক গে। যখন কাজের জন্য ডেকে পাঠাই তখন তো পাত্তা পাওয়া যায় না। আর এখন নিজের যখন গরজ পড়েছে তখন এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে। হতভাগা বেজন্মা কোথাকার। বেইমান’। কিন্তু এখন রাগ দেখানোর সময় নয়। প্রতিশোধ নেওয়ারও সময় এটা নয়। কিছুটা দোনোমনা করে দুটো টাকা বের করে ঘিসুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি। কিন্তু সমবেদনার একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। ঘিসুর দিকেও তাকালেন না। শুধু কর্তব্য পালনের জন্যই টাকাটা তিনি ছুঁড়ে দিলেন।
জমিদার যখন দুটাকা দিয়েছেন তখন গাঁয়ের ব্যাপারী আর মহাজন কী আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? জমিদারের নামে কেমন ঢাক পেটাতে হয় সেটা ঘিসু ভালোমতই জানে। জমিদারের কথা শুনে কেউ দু পয়সা দিল, কেউবা চার পয়সা। এক ঘণ্টার মধ্যে দেখতে দেখতে পাঁচ টাকা চলে এল তাদের হাতে। কেউ আবার চাল দিল, কেউ কাঠ। বিকেলের দিকে ঘিসু আর মাধব বাজারে গেল কফন কিনতে। এদিকে লোকজন গেল বাঁশ কাটতে ।
বুধিয়াকে শেষ দেখা দেখার জন্য গাঁয়ের বউ ঝিরা এল। বুধিয়াকে এই অবস্থায় দেখে তারা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরল।
৩।
বাপ-বেটায় বাজারে এল। ছেলেকে ঘিসু বলে… ‘ওকে পোড়ানোর জন্য অনেক কাঠ আছে। তাই নারে মাধব?’
মাধব উত্তর দেয়… ‘হ্যাঁ অনেক কাঠ রয়েছে। এবার শুধু একটা কফন লাগবে’।
‘ঠিক আছে পাতলা …জ্যালজ্যালে দেখে একটা কফন কিনে নিই’।
‘ বটে বটে… লাশ নিয়ে যেতে যেতে তো রাত হয়ে যাবে। তখন কে আর দেখবে?’
‘সমাজের কী অদ্ভূত নিয়ম! বেঁচে থাকতে আব্রু রক্ষার জন্য যে একটা ছেঁড়া কাপড়ও পেল না। মরার পর তার জন্যই আবার নতুন কফন চাই’।
‘ শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তো কফনও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে’।
‘হ্যাঁ এটা তো আর কোনো কাজেই লাগবে না। এই পাঁচ টাকা যদি আমাদের হাতে আগে থাকত, তাহলে ওকে কিছু ওষুধপত্র দিতে পারতাম’।
একজন কী ভাবছে অন্যজন তা ঠিক আঁচ করতে পারে। বাজারে গিয়ে তারা এদিক, ওদিক ঘুরতেই থাকে। ওদিকে সন্ধ্যা নেমে আসে। একটার পর একটা কাপড় দোকানে তারা পাক খেয়েই যায়। নানান রকম কাপড় তারা দেখে…রেশম, তাঁত। কিন্তু কোনোটাই তাদের পছন্দ হয় না। ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের অজান্তেই একটা ভাটিখানার সামনে চলে আসে তারা। তারপর ভাটিখানার ভেতরে ঢোকে…যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল সব। ভেতরে ঢুকে প্রথমটা হতভম্ব হয়ে পড়ে তারা। তারপর ঘিসু দোকানির কাছে গিয়ে বলে ‘আমাদেরও একটা বোতল দিন’। ঘিসু মদ নিয়ে আসে। সেইসঙ্গে কিছু তিলের নাড়ু। এবার মদের সঙ্গে চাটও আসে। আসে মাছভাজা । দোকানের বারান্দায় নিশ্চিন্ত মনে বসে তারা ঢুক ঢুক গিলেই যায়। কয়েক পাত্তর গেলার পর মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে। ঘিসু বলে… ‘ওকে কফন দিয়ে ঢাকার কী দরকার। ওটা তো ওর সঙ্গেই পুড়ে যাবে। ও তো আর সঙ্গে করে কিছু নিয়ে যাবে না’।
মাধব আকাশের দিকে তাকায়…সে যে নিরপরাধ, তার যে কোনো দোষ নেই সেটাই যেন আকাশের দেবদূতদের কাছে ঘোষণা করতে চায় সে… ‘এটাই তো জগতের নিয়ম। তা নাহলে বামুনদের হাজার হাজার টাকা দেয় কেন লোকে? এসবের ফল সগ্গে পৌঁছোয় কিনা তা কে বলতে পারে!’
‘বড়লোকের প্রচুর টাকা আছে। তারা সেই টাকা উড়িয়ে পুড়িয়ে দিক গে। কিন্তু আমরা কেন টাকার অপচয় করতে যাব?’
‘কিন্তু তুমি গাঁয়ের লোকেদের কী বোঝাবে? ওরা জিগ্যেস করবে না যে কফন কোথায়?’
ঘিসু তো হেসেই খুন… ‘তাদের বলে দিস যে আমার কোঁচড় থেকে টাকাগুলো পড়ে গেছে। আমরা অনেক খুঁজেছি। পাইনি। লোকজন হয়তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তারা আবার টাকা দেবে’।
এইভাবে নিয়তিক জয় করার আনন্দে মাধবও হেসে ফেলে… ‘বড় ভালো ছিল বউটা। বেচারি! মরে গিয়েও সে আমাদের ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল’।
বোতল এখন অর্ধেকেরও বেশি খালি। ভাটিখানার পাশেই খাবার দাবারের দোকান। দোকানিকে দু সের লুচি, মাংশের ঝোল, মেটের তরকারি আর মাছভাজা দিতে বলে ঘিসু। মাধব ছুটে দিয়ে পাতায় মুড়ে খাবার নিয়ে আসে। এখানেই দেড় টাকা খরচ হয়ে গেল। আর মাত্র কয়েক পয়সা পড়ে আছে।
ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন শিকার দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি বাপ-বেটাও গোগ্রাসে লুচি গিলতে থাকে। লোকলজ্জা, লোকনিন্দার ভয় তারা করে না। লজ্জা, শরমের মাথা তারা কবেই খেয়ে বসে আছে। এবার
দার্শনিকের মতো কথা বলে ঘিসু… ‘আমার প্রাণটা একটু ঠান্ডা হলে বউটারও একটু পুণ্যি হয়, সগগে যায় তাই না? ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয় মাধব… ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। ভগবান তুমি তো সবার মন পড়তে পারো… ওকে স্বর্গেই নিয়ে যেয়ো। আমরা দুজনে ওকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করছি। আজ পেটপুরে যা খেলাম…সারা জীবনে অমন খাইনি’।
খানিক্ষণ পরে ধন্দ জাগে মাধবের মন। বাপকে সে জিগ্যেস করে… ‘ সগ্গটা কেমন? আমরাও তো একদিন সেখানে যাব তাইনা?’
ঘিসু কোনো জবাব দেয় না। এই ছেলেমানুষের মতো কথার কীইবা জবাব দেবে। মনে মনে সে ছেলেকে তিরস্কার করতে চায়। সগ্গের কথা ভেবে এখনকার আনন্দকে মাটি করতে চায় না সে’।
‘সগ্গে ও যদি আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা ওকে কফন দেইনি কেন? তখন তুমি কী জবাব দেবে শুনি?’
‘ ওহ। এবার চুপ কর’।
‘ ও নিশ্চয়ই আমাদের জিজ্ঞেস করবে’।
‘ ওকে কফন দেওয়া হবে না কে বলল। আমাকে কি অত গাধা পেয়েছ নাকি? তিন কুড়ি বয়স হল আমার। আমার চুলটা কি রোদে পেকেছে। ওকে কফন দেওয়া হবে। খুব ভালো কফন। আমরা যা দিয়ে পারতাম তার চেয়ে অনেক ভালো’।
মাধবের ঠিক বিশ্বাস যায় না। তার মনে এখনও ধন্দ… ‘ তাহলে কে দেবে কফন? সব পয়সা তো উড়িয়ে দিলে। সগ্গে গিয়ে আমাকেই তো জবাবদিহি করতে হবে। আমিই যে ওর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়েছিলাম’।
বড় বিরক্ত লাগে ঘিসুর… ‘আমি তো বলছি ও কফন পাবে। আমার কথায় বিশ্বাস যাচ্ছে না’।
‘ কিন্তু কে টাকা দেবে? আমাকে সব খুলে বলছ না কেন?’
‘যারা এখন আমাদের পয়সা দিয়েছিল তারাই দেবে। ওরা আমাদের হাতে পয়সা দেবে না। যদি কেউ দিয়ে ফেলে তাহলে তো আমরা এখানে বসে মদ খেয়েই সব ফুটিয়ে দেব। তারপর ওরাই একটা কফন কিনে দিয়ে দেবে’।
অন্ধকার নামে। আকাশের গায়ে এক ঝুড়ি তারা জ্বলজ্বল করে আগুনের ফুলকির মতো। ভাটিখানায় এখন তুমুল হইহল্লা। একজন গান গেয়ে ওঠে…আরেকজন বকবক করে যায়, কেউ আবার সঙ্গীকে জাপটে ধরে, কেউ বন্ধুর মুখে গেলাস চেপে ধরে। আজ আকাশে বাতাসে শুধুই আনন্দ…শুধুই ফূর্তি। বাতাসেরও যেন আজ নেশা লেগেছে। কত লোক গেলাস হাতে মাতলামি করে যাচ্ছে। নিজেদের ভুলে থাকার সুখটুকু পেতেই এখানে এত মানুষের ভিড়। মন নয় এখানকার বাতাসই তাদের মাতাল করে দিয়েছে। জীবনে একের পর এক দুর্যোগ…দুর্বিপাক তাদের এখানে টেনে এনেছে। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে না আধমরা হয়ে রয়েছে তাও ঠাওর করতে পারে না।
বাপ-বেটা এখনও গিলে যাচ্ছে। তাদের দিকেই সবার চোখ। সবাই ভাবছে ঐ বাপ-বেটার কী ভাগ্য! দুজনে মিলে পুরো এক বোতল সাবাড় করে ফেলল!’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে। যেটুকু লুচি পাতায় পড়ে আছে সেটা এক ভিখারিকে দিয়ে দেয় মাধব। ভিখারিটা অনেক্ষণ ধরে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দেওয়ার মধ্যে যে কত সুখ, কত তৃপ্তি তা জীবনে এই প্রথমবার অনুভব করল মাধব।
এবার ভিখারিটাকে ঘিসু বলে… ‘এই নে পেটপুরে খা। যার পয়ে আজ তুই খাচ্ছিস সে মরেছে। কিন্তু তোর আশীর্বাদ নিশ্চয়ই তার কাছে পৌঁছবে। মন প্রাণ দিয়ে আশীর্বাদ কর ওকে। কত খাটাখাটনি করে এইটুকু জুটিয়েছে ও।
মাধব আবার আকাশের দিকে চায়… ‘ও সগ্গে যাবে। ও সগ্গের রানি হবে’।
টলতে টলতে ঘিসু উঠে দাঁড়ায়। সে যেন কোন আনন্দের সাগরে ভাসছে। ছেলেকে সে বলে… ‘হ্যাঁ বেটা ও নিশ্চয়ই সগ্গে যাবে। সে কাউকে কোনোদিনও কষ্ট দেয়নি…কাউকে কটু কথা বলেনি। এমনকী মরেও সে আমাদের হাতে কতগুলো ট্যাকা তুলে দিয়েছে। সে সগ্গে যাবে না তো আর কে যাবে? যারা গরিবদের রক্ত চুষে খায় আর তারপর গঙ্গায় ডুব দিয়ে আর মন্দিরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিজেদের সব পাপ ধুয়ে ফেলতে চায় সেই চশমখোর বড়লোকগুলো কি তবে সগ্গে যাবে?’
এখন আর ওই সগ্গ আর ভগবানের কথা ভালো লাগে না তাদের। নেশা করলে মনে কখন যে কী ভাব আসে সে আর কে বলতে পারে? এবার তাদের শোকতাপ হয়। যন্ত্রণায় ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। মাধব বলে… ‘বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর কষ্টেই মরল’। হাত দিয়ে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মাধব।
ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ঘিসু… ‘ এত কাঁদছিস কেন বেটা। এই মায়ার সংসার থেকে সে মুক্তি পেয়েছে এটা ভেবেই একটু হাস। ও তো ভাগ্যবতী! দেখ কত তাড়াতাড়ি সে এই মায়ার জাল কেটে চলে যেতে পারল’!
এবার বাপ-বেটা দুজনে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় গান ধরে… ‘ও ছলনাময়ী, তোমার চোখে কেন আগুন। ছলনাময়ী’।
ভাটিখানায় যত লোক ছিল তারা সব তাজ্জব হয়ে বাপ-বেটার কাণ্ড দেখে। মদে চূর হয়ে গান করে যায় দুজনে। তারপর আবার নাচ শুরু করে । তারা লাফায়, ঝাঁপায়… টলে মাটিতে পড়ে যায়… গড়াগড়ি খায়, নানা রকম অঙ্গভংগি করে যায়। তারপর একসময় নেশার ঘোরে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।